ইউআইইউ-এর অগ্রযাত্রার ইতিহাস
মাত্র ৭৬ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ২০০৩ সালে যাত্রা শুরু করে আজকের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। অনেক বাঁধাবিঘ্ন পেরিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় আজকে উন্নতমানের শিক্ষা আর গবেষণার এক অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির যাত্রাপথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি এর বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসনের সহযোগিতায় দৃঢ় প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। পচিশ হাজারের অধিক অ্যালামনাই ও শিক্ষার্থী আজ ইউআইইউ-এ তাদের জীবন গড়ে তুলেছে। ক্লাসরুম ও ক্লাসরুমের বাইরে পড়াশোনা, নানান দক্ষতা অর্জন এবং সার্বিক মননশীলতার বিকাশে দেশী-বিদেশী অভিজ্ঞ শিক্ষকবৃন্দ প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদানে সদা তৎপর রয়েছেন।
গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা
ইউআইইউ-এর ইনস্টিটিউট অব এডভান্সড রিসার্চ দেশের সেরা গবেষণা কেন্দ্রগুলোর অন্যতম, যেখানে দেশের এবং বিদেশের গবেষকদের সমন্বয়ে শতাধিক গবেষণা প্রকল্প চালু আছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এই গবেষণার কাজে প্রতি বছর দুই কোটি টাকা অনুদান দিয়ে আসছে। গবেষণা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগেও ইউআইইউ একটি নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইউআইইউতেই সর্বপ্রথম সরকারের তিন কোটি টাকার প্রকল্প “ইনোভেশন হাব” বাস্তবায়িত হয়, যেখানে এখন সামাজিক উন্নয়নসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত আছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বিত বেশ কয়েকটি গবেষক দল। রিসার্চ, ইনোভেশন, ইনকিউবেশন, এবং কমার্শিয়ালাইজেশন এই ইনোভেশন হাবের কর্মপদ্ধতি, যেটার উদ্দেশ্য হচ্ছে গবেষকদের উদ্ভাবনকে মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রায়োগিক রূপ দেয়া ও সেগুলোকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় প্রতিযোগিতাগুলোতে আমাদের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ এবং নিয়মিত পুরস্কার পাওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচুমানের শিক্ষার পরিবেশেরই সাক্ষ্য বহন করে। বিগত বছরগুলোর ন্যায় এই বছরেও আমাদের শিক্ষার্থীদের দলগুলো রোবটিক্সসহ অন্যান্য বিষয়ে বিশ্বজুড়ে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে।
জুলাই আন্দোলন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান
গত বছরের মাঝামাঝি, জুলাই মাসে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে জাতীয় গণআন্দোলনের সূচনা হয়, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ইউআইইউ ছিল অগ্রভাগে। আন্দোলনের উত্তাল সেই দিনগুলিতে প্রচন্ড চাপের মুখেও ইউআইইউ প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। একারণেই ইউআইইউ-এর উপাচার্যকে ডেকে পাঠায় তৎকালীন ইউজিসি এবং সতর্ক করে যে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সহায়তা অব্যাহত রাখলে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নেবে ইউজিসি। শত চাপের মুখেও উপাচার্য ঐ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের নাম ইউজিসির কাছে প্রকাশ করেননি। কৌশলগত কারণেই আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে এইসব সহায়তার কথা সেসময় সযত্নে গোপন রাখা হয়। যখনই সম্ভব হয়েছে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে খাবার সরবরাহ করা হয়েছে, নতুনবাজার এলাকায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়া একটি মেস থেকে ছাত্রীদের চরম ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের এবং অন্যান্য আহতদের ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল এবং শহরের অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে অব্যাহতভাবে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনের শেষ দিকে জেলে থাকা ইউআইইউ-এর শিক্ষার্থীদেরকে মুক্ত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রতিথযশা আইনি ফার্মকে নিয়োগ দেয় এবং বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কারাগার থেকে মুক্ত করে।
শহীদ ইরফান ভুঁইয়া স্মরণ ও সহায়তা
জুলাই আন্দোলনে শহীদ ইউআইইউ-এর ছাত্র ইরফান ভুঁইয়ার স্মরণে নেয়া হয় নানাবিধ কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীর নামকরণ করা হয় “শহীদ ইরফান লাইব্রেরী” নামে। ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটি ল্যাবকেও নামকরণ করা হয় শহীদ ইরফানের নামে, যেখানে ইরফানের পিতা একজন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। এক ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা ইরফানের পিতা তাঁর একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁর পরিবারকে এই অনিশ্চয়তার হাত থেকে কিছুটা মুক্তি দিতে ইউআইইউ-এর বোর্ড অব ট্রাস্টিজসহ ইউআইইউ পরিবার এগিয়ে আসে। শহীদ ইরফানের পিতার হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ-এর সভাপতি মহোদয় ও উপাচার্য পঞ্চাশ লক্ষ টাকার চেক হস্তান্তর করেন।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এবং প্রশাসনের পদক্ষেপ
৫ই আগস্ট ২০২৪-এর পর আমাদের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়সংক্রান্ত কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে সোচ্চার হয়। দাবীগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় বসে। ২১শে আগস্টে একটি লিখিত বিবরণীতে ছোটবড় প্রায় ৫০টির বেশী প্রস্তাবনা বিষয়ে ঐকমত্য হয়। তবে গ্রেডিং সিস্টেম পরিবর্তনের বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। শিক্ষার্থীদের উত্থাপিত প্রস্তাবনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, নিহত ও আহত শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সহযোগিতা; শহীদ ইরফানের স্মৃতির সম্মানে কার্যক্রম; আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত অভিভাবকদের সহায়তার জন্য জুলাই সেমিস্টারের টিউশন ফি-এর অংশবিশেষ মওকুফ; পুলিশি হেফাজতে থাকা শিক্ষার্থীদেরকে আইনী সহযোগিতা; শিক্ষার মান আরও উন্নত করতে নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ; অবকাঠামো, পরিষেবা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান; শিক্ষক ও প্রশাসনে পরিবর্তন; শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা; ক্লাব ফোরামগুলোর কার্যক্রম আধুনিকায়ন; রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত রাখা; বিভিন্ন ফি-সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধন; এবং গ্রেডিং স্কেলের পরিবর্তন।
গ্রেডিং স্কেল বিতর্ক
গ্রেডিং স্কেল যেহেতু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলমার্ক তথা উঁচুমানের শিক্ষা প্রদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, তাই এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে দেয়, এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য। কমিটি সেপ্টেম্বরের শুরুতে প্রস্তাবিত বিস্তারিত রিপোর্টে গ্রেডিং পদ্ধতি পরিবর্তনের বিপক্ষে সুপারিশ করে, এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কমিটির সুপারিশ মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ক্যাম্পাসে ভায়োলেন্স করে; শিক্ষক মন্ডলী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দকে ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ করে রাখে, যা একটি দুঃখজনক শিক্ষা পরিবেশ তৈরি করে।
গ্রেডিং সিস্টেম ছাড়া অন্য সব দাবী মেনে নেওয়ার পরও এমনভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাবিধি লংঘনের দায়ে কিছু শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গঠিত একটি তদন্ত কমিটি বিষয়টি তদন্ত করে রিপোর্ট দেয়। অভিযোগগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখার বৃহত্তর স্বার্থে ইউআইইউ-এর শৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটি অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদেরকে প্রাপ্য শাস্তি না দিয়ে তাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বিষয়টির সুরাহা করে। যেখানে বলা হয় যে, ভবিষ্যতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলবিরোধী যে কোন কার্যকলাপে জড়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারসহ অন্যান্য কঠোর ব্যবস্হা গ্রহণ করা হবে।
প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন
গত কয়েকমাসে প্রতিশ্রুত বিষয়গুলোর অধিকাংশই পূর্ণ বা আংশিকভাবে কার্যকর করা হয়েছে (প্রতিশ্রুত বিষয়সমূহের ব্যপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহিত ব্যবস্থাসমূহ সংলাগ-১ এ সংযুক্ত করা হলো)। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় যে, আর্থিক বা টিউশন ফি সংক্রান্ত সব দাবী তাৎক্ষণিকভাবে পূরণ করা হয়েছে। অবকাঠামো বা পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে গত মাসগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে, এখনও করছে। গত কয়েকমাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবগুলোর উন্নয়নে কয়েক কোটি টাকা দিয়ে কম্পিউটারসহ নানা যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। নতুন নতুন বেশ কয়েকটি আধুনিক ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগগুলোর ল্যাবগুলো দেশের সেরাদের মধ্যে অন্যতম। আমাদের ফার্মেসি বা বায়োটেকনোলজী ল্যাব দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ। এই উন্নয়ন প্রক্রিয়া প্রকৃতপক্ষে জুলাইয়ের অনেক আগে থেকেই চালু ছিল, যা আমাদের উঁচু মানের শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি গবেষণার প্রতি আমাদের গভীর মনোযোগের সাক্ষ্য বহন করে।
নতুন আন্দোলন ও উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি
তবে গ্রেডিং পদ্ধতির পরিবর্তন তথা শিক্ষার মানের বিষয়ে কোনরকম ছাড় দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্ত অস্বীকৃতি অ্যালামনাই ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অকুণ্ঠ সমর্থন অর্জন করলেও কিছু শিক্ষার্থী বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াসহ নানা মাধ্যমে মাঝেমধ্যেই সমস্যা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। ইউআইইউ-এর বর্তমান প্রশাসন, বিশেষত উপাচার্য মহোদয়কে তারা এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় বাঁধা বলে সাব্যস্ত করে। সম্প্রতি কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধানের অসাবধানতার কারণে সৃষ্ট একটি দুর্ঘটনার সুযোগ নিয়ে, যেটি খুব সহজেই সমাধান করা যেত, সেই কয়েকজন শিক্ষার্থী আবার আকস্মিকভাবে আন্দোলনে নামে। ঐ বিভাগের প্রধানের পদত্যাগের দাবিতে ২৬শে এপ্রিল, ২০২৫, শনিবার সকাল নয়টায় শুরু হয় প্রতিবাদ সমাবেশ। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই তারা বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেয়।
বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ডীনের নেতৃত্বে একটি শিক্ষক প্রতিনিধিদলকে পাঠানো হয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলার জন্য। আশ্চর্যজনকভাবে তারা এই প্রতিনিধিদল বা অন্য কারও সাথে কোনরকম কথা বলতে অস্বীকৃতি জানায়। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তারা বিভাগীয় প্রধানের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগও দাবী করে! বারবার তাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কথা বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ঐদিনই বিকেল নাগাদ তারা উপাচার্যের অফিসকক্ষের সামনে অবস্থান নিয়ে চরম অচলাবস্থার সৃষ্টি করে। ইতোমধ্যে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান পদত্যাগ করতে সম্মত হলেও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে অনড় থাকে।
সন্ধ্যায় উপাচার্য এবং তাঁর কক্ষে উপস্থিত সিনিয়র শিক্ষকবৃন্দ সেদিনের মতো আন্দোলন স্হগিত রাখার প্রস্তাব দিয়ে পরদিন এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলেও উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করবে বলে ঘোষণা দেয়। এই পর্যায়ে উপাচার্য বাড়ি যেতে চাইলে তাঁকে আটকে দেওয়া হয়; বলা হয়, পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তাঁকে অফিস কক্ষ ত্যাগ করতে দেওয়া হবে না। কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই কিছু শিক্ষার্থীর এমন দাবী উত্থাপনে উপাচার্য মহোদয় যারপরনাই অসম্মানিত বোধ করেন। এক পর্যায়ে রাত আনুমানিক আটটার দিকে উপাচার্য মহোদয় পদত্যাগ করেন এবং পদত্যাগপত্র বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠিয়ে দেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। শিক্ষার্থীদের এমন অন্যায় ও অন্যায্য দাবীর মুখে মব সৃষ্টির মাধ্যমে উপাচার্যকে পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল একাডেমিক-প্রশাসনিক প্রধান বা পরিচালকের পদে কাজ করা সকল শিক্ষকবৃন্দ তাৎক্ষণিকভাবে সম্মিলিত পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
আন্দোলনকারীদের নেতৃত্ব এরপরেও উপাচার্য এবং তাঁর কক্ষে উপস্থিত প্রায় ২০ জন সিনিয়র শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করে রেখে দাবী তোলে যে, উপাচার্যকে তাঁর পদত্যাগপত্রের ভাষা পরিবর্তন করতে হবে! উপাচার্য মহোদয় যে চাপের মুখে অসম্মানিত হয়ে পদত্যাগ করেছেন, পদত্যাগপত্রে এমন উল্লেখ থাকা যাবে না মর্ম্মে কয়েকজন ছাত্র চাপ সৃষ্টি করে। এহেন অযৌক্তিক দাবি মানতে উপাচার্য মহোদয় সরাসরি অস্বীকার করেন। ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত উপাচার্যসহ পদত্যাগকারী সব শিক্ষকবৃন্দকে জিম্মি করে রাখা হয়। অতঃপর আন্দোলনকারীরা উপাচার্য ও অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দকে ছেড়ে দেয়। এই পুরো ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে ইউআইইউ-এর কয়েকজন শিক্ষার্থী সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায় রচনা করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রুত পুনরায় কার্যক্রমে ফিরে আসা
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে সার্বিক পর্যালোচনার জন্য বোর্ড অব ট্রাস্টিজ একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২৮শে এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আন্দোলনের জন্য নয়, বরং আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাবিধি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রক্টোরিয়াল কমিটি প্রাপ্ত প্রমাণাদি পর্যালোচনা করে কিছু শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে। তাদের জবাবের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটি এদের কয়েকজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে, যাদের মধ্যে কয়েকজনকে বিগত আন্দোলনের সময়ও শৃঙ্খলাবিধি লংঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সতর্কতামূলক বার্তা প্রদান করা হয়েছিলো। কয়েকজনকে সাসপেন্ডেড বহিষ্কার (ভবিষ্যতে শৃঙ্খলাবিধি লংঘন করলে স্হায়ীভাবে বহিষ্কার করা হতে পারে), এবং একজনকে শুধুমাত্র সতর্কতামূলক বার্তা দেওয়া হয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ইউআইইউ-এর প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এদের সবাইকে দশ কার্যদিবসের মধ্যে আপিল করার সুযোগও দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ২০শে মে থেকে অনলাইনে ক্লাস শুরু করা হয়, যা ঈদের ছুটির আগে পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ঈদের ছুটির পর পূনরায় অনলাইন ক্লাস শুরু করা হয়েছে এবং আশা করা যায় যে যতদ্রুত সম্ভব সময়ে ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে।
মুষ্টিমেয় শিক্ষার্থীর আচরণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হতাশা
গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর অন্যায় এবং মবমূলক আচরনের জন্য দশ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী আজ এক চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সবার কাছে এজন্য দুঃখ প্রকাশ করছে। তবে অতি শীঘ্রই এইসব সাধারণ শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে আসে, নিজেদেরকে জীবনসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে তারা চায় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক এবং আনন্দময় পরিবেশে বিরাজ করুক। স্বার্থান্বেষী কোন মহলের প্ররোচনায় বিপথে যাওয়া কিছু শিক্ষার্থীর কারণে যাতে আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণ ব্যাহত না হয়, সে বিষয়ে আমরা সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করছি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতা
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি এখানে আলোকপাত করা দরকার। আমরা জানি যে, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত সরকার থেকে কোনরকম আর্থিক সহায়তা বা অনুদান পায় না। অন্য সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ইউআইইউ-ও শিক্ষার্থীদের থেকে পাওয়া টিউশন ও অন্যান্য ফি-এর উপর নির্ভরশীল। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আয় শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আবর্তক খরচ ও শিক্ষার মান উন্নয়নেই ব্যয় করা হয়। অভিভাবকবৃন্দ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাঁদের সন্তানদেরকে পড়াশোনার জন্য পাঠান এই আশায় যে, তাঁদের সন্তানরা উচ্চ মানের শিক্ষা পাবে এবং ঠিক সময়মত অর্থাৎ কমবেশি চার বছরের মধ্যেই আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানদের পাঠানোর আরেকটি বড় কারণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির অনুমতি না থাকা, যেটি এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরবিচ্ছিন্ন একাডেমিক কার্যক্রমের নিশ্চয়তা দেয়। আজকে যদি পড়াশোনায় অমনোযোগী মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষার্থীর জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন বিপন্ন হয়, অভিভাবকরা তাঁদের বিনিয়োগের যোগ্য ফলাফল তথা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষাগত সাফল্য না পান, সেটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। এরকম মব সংস্কৃতি শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নয়, দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে।
আন্দোলনের চেতনাকে অপব্যবহার করার অপচেষ্টা
দুঃখজনকভাবে, কিছু সুবিধাবাদী শিক্ষার্থী তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই আন্দোলনের মহিমা, বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবের ঐতিহাসিক গুরুত্বকেই কালিমালিপ্ত করছে। আন্দোলনের প্রকৃত চেতনার সঙ্গে এদের কার্যকলাপের কোনো মিল নেই।
সম্মিলিত আহ্বান
আজ সময় এসেছে, শিক্ষাঙ্গনে মব সংস্কৃতির অবসান ঘটানোর। স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষার্থীর হাতে আমরা আমাদের হাজার হাজার সাধারণ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন জিম্মি হতে দিতে পারি না। এসব শিক্ষার্থীর একাডেমিক সুরক্ষার জন্য আমরা যা কিছু করার দরকার, সবকিছুই করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা আশা করি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সকল ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকগণ আমাদের এই কঠিন সময়ে আমাদের পাশে থাকবেন এবং সকল শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন নিরবচ্ছিন্ন ও সফল করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন। আমরা সকল ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবকবৃন্দ, শিক্ষকমন্ডলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের সহায়তা নিয়ে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।